প্রশ্নঃ আকিকার হুকুম কি, কখন করতে হয়? আকিকার মাংস কে খেতে পারে? গরু দিয়ে আকিকা করা যাবে কি?কোরবানীর সাথে ভাগে আকীকা দেয়া যাবে কি?
উত্তরঃ ইসলামের পরিভাষায় সন্তান জন্ম গ্রহণ করার পর আল্লাহর শুকরিয়া ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে পশু জবাই করা হয়, তাকে আকীকা বলা হয়।
আকীকার হুকুমঃ অধিকাংশ আলেমের মতে সন্তানের আকীকা করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। রাসূসুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি তার সন্তানের আকীকা করতে চায়, সে যেন উহা পালন করে”। (আহমাদ ও আবু দাউদ)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেনঃ
প্রতিটি সন্তানই আকীকার বিনিময়ে আটক থাকে”। (আহমাদ, তিরমিজী ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থ)
আকীকা করার সময়ঃ আকীকার জন্য উত্তম সময় হলো সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার সপ্তম দিবস। সপ্তম দিনে আকীকা করার
সাথে সাথে সন্তানের সুন্দর নাম রাখা, মাথার চুল কামানো এবং চুল এর সমপরিমাণ ওজনের রৌপ্য ছাদকাহ করাও মুস্তাহাব। (তিরমিজী)
বিনা কারণে আকীকা দেওয়াতে বিলম্ব করা সুন্নাতের বিরোধীতা করার অন্তর্ভুক্ত।
দারিদ্র বা অন্য কোন কারণে যদি ৭ দিনে আকীকা করতে অক্ষম হয়, তবে যখনই অভাব দূর হবে, তখনই আকীকা করা জায়েজ আছে।
কোন ধরণের পশু দিয়ে আকীকা করতে হবে? সংখ্যা কয়টি?
আকীকার ক্ষেত্রে সুন্নাত হলো, ছেলে সন্তান হলে দু‘টি দুম্বা বা ছাগল আর মেয়ে সন্তান হলে একটি দুম্বা বা ছাগল দিয়ে আকীকা করা।
কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
“ছেলে সন্তানের পক্ষ থেকে দু‘টি সমবয়সের ছাগল এবং মেয়ে সন্তানের পক্ষ থেকে একটি ছাগল দিয়ে আকীকা দিতে হবে।
(আহমাদ ও তিরমিজী) আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে যদি ছেলে সন্তানের পক্ষ থেকে দু‘টি ছাগল দিয়ে আকীকা দিতে না পারে,
তবে একটি দিয়ে আকীকা দিলেও চলবে।
আকীকার গোশত কে খেতে পারে?
আকীকার গোশত কুরবানীর গোশতের মতই। তা নিজে খাবে, আত্মীয় স্বজনকে খাওয়াবে এবং গরীব-মিসকীনকে ছাদকা করবে।
আকীকার গোশতও কুরবানির মত তিন ভাগ করা জরুরী নয়।
আকীকার গোশত যদি সম্পূর্ণটাই রান্না করে এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং অন্যান্য মুসলমানদেরকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায় তাতেও যথেষ্ট হবে।
গরু দিয়ে আকীকা করাঃ
কোন হাদীসেই গরু দিয়ে আকীকা করার কথা উল্লেখ হয়নি। অথচ রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর যুগে সবধরণের পশুই বিদ্যমান ছিল।
সুতরাং উত্তম হচ্ছে ছাগল বা দুম্বা দিয়েই আকীকা করা।
কোরবানীর সাথে ভাগে আকীকা দেয়াঃ
আমাদের দেশে সাতভাগে গরু দিয়ে কুরবানী করার ক্ষেত্রে আকীকার অংশীদার হওয়ার নিয়ম ব্যপকভাবে প্রচলিত আছে।
এটি হাদীছ সম্মত নয়। আকীকা যেহেতু একটি এবাদত, তাই হাদীছে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবেই পালন করা উচিত।
-লেখক: আব্দুল্লাহ শাহেদ আল মাদানী
[দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব।]
কোরবানীর সাথে আকীকা দেয়া যাবে কি?
আমাদের দেশে সাতভাগে গরু দিয়ে কুরবানী
করার ক্ষেত্রে আকীকার অংশীদার হওয়ার নিয়ম ব্যপকভাবে প্রচলিত আছে।
এটি হাদীছ সম্মত নয়। একটি গরু দিয়ে একজন সন্তানের আকীকা করা যদি ঠিক না হয়, তাহলে কুরবানীর গরুর সাথে ভাগে আকীকা করা সঠিক হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
সর্বোপরি কতিপয় আলেম কোরবানীর গরুর সাথে ভাগে আকীকা দিলে তা বৈধ হবে বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু তা হাদীছ সম্মত নয়।
আক্বীকা একটি ইবাদত যার সময়-কাল ও উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র। অনুরূপ কুরবানীও একটি স্বতন্ত্র ইবাদত যার সময়-কাল ও উদ্দেশ্য নির্ধারিত।
কিন্তু উভয়কে একত্রীকরণে উভয়ের সময় ও উদ্দেশ্য তথা উভয় ইবাদতকে একীকরণ করা হয়, যা নিঃসন্দেহে ভুল তথা শরীয়তে হস্তক্ষেপ।
আকীকার ক্ষেত্রে কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাসঃ
কিছু লোক বিশ্বাস করে যে, সন্তানের পিতা-মাতা এবং যে সন্তানের আকীকা দেওয়া হলো, সে সন্তান আকীকার গোশত খেতে পারবেনা।
এটি একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। এ মর্মে কোন দলীল-প্রমান নাই।
আকীকার গোশত কুরবানীর গোশতের মতই। পরিবারেই সবাই খেতে পারবে।
আকীকা দিতে অক্ষম হলেঃ
দারিদ্রতার কারণে আকীকা দিতে অক্ষম হলে, আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
যখনই সামর্থবান হবে, তখনই আকীকা করবে। আর যদি আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হয় এবং আকীকা দিতে না পারে,
তাহলে কোন গুনাহ হবেনা।
পশুর ভাগা অংশ দিয়ে আক্বীক্বা করা যাবে কি?
→ ‘কুরবানী ও আক্বীক্বা দু’টিরই উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করা’ এই (ইহতিসানের) যুক্তি দেখিয়ে
কোন কোন হানাফী বিদ্বান কুরবানীর গরু বা উটে এক বা একাধিক সন্তানের আক্বীক্বা সিদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন (যা এদেশে অনেকের মধ্যে চালু আছে)।
(আশরাফ আলী থানভী, বেহেশতী জেওর (ঢাকাঃ এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১০ম মুদ্রন ১৯৯০) ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায়, মাসআ-২, ১/৩০০ পৃঃ; বুরহানুদ্দীন মারগানানী, হেদায় (দিল্লিঃ ১৩৫৮ হিঃ)
‘কুরবানী’ অধ্যায় ৪/৪৩৩ পৃঃ; (দেওবন্দ ছাপা ১৪০০ হিঃ) ৪/৪৪৯ পৃঃ)।
→ হানাফী মাযহাবের স্তম্ভ বলে খ্যাত ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) এই মতের বিরোধীতা করেন।
→ ইমাম শাওকানী (রহঃ) এর ঘোর প্রতিবাদ করে বলেন, এটি শরী’আত। এখানে সুনির্দিষ্ট দলীল ব্যতীত কিছুই প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
(নায়লুল আওত্বার, ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায় ৬/২৬৮ পৃঃ)।
বলা আবশ্যক যে,
কুরবানীর পশুতে আক্বীক্বার ভাগ নেওয়ার কোন প্রমাণ রাসূলুল্লাহ বা সাহাবায়ে কেরামের কথা ও কর্মে পাওয়া যায় না।
এটা স্রেফ ধারণা ভিত্তিক আমল, যা হানাফী মাযহাবের দোহাই দিয়ে এদেশে চালু হয়েছে। যদিও ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ) থেকে এ বিষয়ে কোন নির্দেশ নেই।
(মাসায়েল কুরবানী ও আক্বীক্বা পৃঃ ২০)।
→ কুরবানী ও আক্বিকার জন্য পৃথক পৃথক পশু হতে হবে। যেমন একটি পশু কুরবানী ও আক্বিকা দুই নিয়্যতে জবেহ করা বাঞ্ছনিয় নয়।
(কুরবানীর বিধান পৃঃ ২৪, আব্দুল হামিদ মাদানী)।
সমাজে প্রচলিত কুরবানীর পশুতে আক্বীক্বার নিয়ত করা শরী‘আত সন্মত নয়। রাসূল(সা:)বা সাহাবায়ে কেরামগনের যুগে এধরনের আমলের অস্তিত্ব ছিলনা।
(নায়লুল আওত্বার ৬/২৬৮,‘আক্বীকা অধ্যায়’;মিরআত২/৩৫১ও৫/৭৫)।
রাসূল(সা:) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি এমন আমল করল যার উপর আমার নির্দেশ নেই সে আমলটি অগ্রহনযোগ্য”।
(বুখারী, মুসলিম-৩২৪৩)।
আল্লাহ তা‘য়ালা বলেনঃ
“আল্লাহ তা‘য়ালা কারও উপর সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেননা।
(সূরা বাকারা-২৮৬)।
আল্লাহ তা‘য়ালা আরও বলেনঃ
“আল্লাহ তা‘য়ালা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠিন বিষয় চাপিয়ে দেননি। (সূরা হজ্জঃ৭৮)।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
“তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তোমাদের সাধ্য অনুযায়ী”। (সূরা তাগাবুন-১৬)।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“যখন আমি তোমাদেরকে কোন কাজের আদেশ দেই, তখন সাধ্য অনুযায়ী তোমরা তা পালন কর।
আর যখন কোন কাজ হতে নিষেধ করি,তখন তা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাক”।
উপরোক্ত দলীল গুলোর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, আকীকাসহ যে কোন আমলই হোক।
না কেন, অক্ষমতার কারণে পালন করতে না পারলে কোন গুনাহ হবেনা।
কিন্তু নিষিদ্ধ বিষয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ। সবধরণের নিষেধ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে।
কারণ নিষেধ থেকে বিরত থাকতে কোন কষ্ট হয়না বা আর্থিক সচ্ছলতার দরকার পড়ে না।
সন্তানের আকীকা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতে মুহাম্মাদী। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা,তিনি যেন আমাদেরকে এ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতটা পারন করার তৌফিক দান করুক
লেখক: আব্দুল্লাহ শাহেদ আল মাদানী
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স
সেন্টার, সৌদী আরব।