অন্যান্য

করোনা ভাইরাস, মহামারী ও বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে

সম্মিলিতভাবে ‘তাকবীর’ ধ্বনি দেয়ার বিধান

প্রশ্ন: বর্তমানে কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে রাতের বেলা একসাথে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তা-ঘাটে, বাড়ির ছাদে বা গাড়িতে বসে উচ্চস্বরে তাকবীর দিচ্ছে বা‘ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করছে। শরিয়তে দৃষ্টিতে এর বিধান কি?

উত্তর:
রোগ ব্যাধি মহামারী ও বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে সম্মিলিত ভাবে তাকবীর পাঠ করা শরিয়তের মধ্যে নব আবিষ্কৃত-বিদআত। ইসলামি শরিয়তে এর কোন ভিত্তি নেই।
নিঃসন্দেহে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ, আল্লা-হু আকবার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জিকির। এগুলো সকাল-সন্ধ্যা, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে এবং রাতে ঘুমানোর পূর্বে নির্দিষ্ট সংখ্যায় পাঠ করার মাধ্যমে আমরা সদকার সওয়াব এবং প্রচুর নেকি কামাইয়ের মাধ্যমে আমাদের আমলনামা ভারী করতে পারি। এ ব্যাপারে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে, বিশেষ পদ্ধতিতে লোকজন ডেকে-হেঁকে উচ্চ আওয়াজে এগুলো পাঠ করার পক্ষে শরিয়তের কোন ভিত্তি নাই। এটাই বিদআত প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
শরিয়ত যা উন্মুক্ত রেখেছে তা উন্মুক্ত রাখতে হবে। সেটাকে বিশেষ পদ্ধতি, বিশেষ দিন-ক্ষণ, বিশেষ পরিস্থিতি কিংবা বিশেষ ক্ষেত্র ইত্যাদিতে নির্দিষ্ট করলে তা শরিয়তের মধ্যে ‘সংশোধনী’ ও ‘সংযোজন’ বলে পরিগণিত হবে-যার অপর নাম বিদআত। (আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন)

আমাদের অজানা নয় যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনে বহু বড় বড় বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি লোকজনকে জমা করে বিশেষ পদ্ধতিতে সমস্বরে তাকবির পাঠ, কোন দুআ মাহফিল, মিলাদ মাহফিল, কুরআন খতম, কালিমা খতমে, খতমে ইউনুস, খতমে খাজেগান, বিশেষ তাহাজ্জুদ, হালকায়ে জিকির ইত্যাদির আয়োজন করেন নি।
সাহাবীদের আমলে ‘তাঊনে আমওয়াস’ নামক মহামারীতে অনেক সাহাবীর প্রাণহানি হয়েছে কিন্তু তারা কখনোই এই জাতীয় কাজ করেননি।
সুতরাং শরিয়তের দলিল ও অনুমোদন ছাড়া এ জাতীয় কাজ করা হবে স্পষ্ট বিদআত এবং গোমরাহি।

◈ আল্লাহ তাআলা বলেন:
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّـهُ ۚ
“অথবা তাদের কি অন্যান্য শরিক আছে যারা তাদেরকে দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু নতুন নতুন বিধান দেয়-যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো অনুমতি দেন নি? (সূরা শুরা: ২১)

◈ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যে ব্যাপারে আমার নির্দেশনা নাই তা পরিত্যাজ্য।” (বুখারি ও মুসলিম)

◈ অন্য হাদিসে এসেছে:
مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’ (বুখারি ও মুসলিম)।

◈ তিনি আরও বলেন,
فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ وَخَيْرَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ وَشَرَّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
“নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী হল আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়েত হল মুহাম্মদের হেদায়েত। আর নিকৃষ্টতম কাজ হল দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হ’ল ভ্রষ্টতা’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১)।
নাসাঈর বর্ণনায় রয়েছে, وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ “আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম।” (নাসাঈ হা/১৫৭৮)।
এ মর্মে আরও অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

তাছাড়া এভাবে ‘সম্মিলিত তাকবীর ধ্বনী দিলে বিপদাপদ দূর হবে’ এমন কোন কথা কুরআন-হাদিসে আসেনি। যদি এতে কল্যাণ থাকত তাহলে অবশ্যই নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে যেতেন এবং সাহাবিগণ সবার আগে তা বাস্তবায়ন করতেন।

সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ধর্মের নামে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। অন্যথায় বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার পরিবর্তে দ্বীনের মধ্যে নতুন সংযোজন করার অপরাধে আল্লাহর ক্রোধ আরও বৃদ্ধি পেয়ে আমাদের উপর নানা রকম বিপদাপদ পতিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।

➧ এর পরিবর্তে আসুন,
● আমরা বেশি পরিমাণে তওবা-ইস্তিগফার করি। (আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি)
● প্রত্যেকেই নিজে নিজে যথাসম্ভব সুন্নতি পদ্ধতিতে তাসবিহ, তাহলিল ও জিকির-আজকারগুলো পাঠ করি এবং অন্যকে উৎসাহি করি।
● মানুষের হক/অধিকার ফিরিয়ে দেই।
● জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করি। কারো প্রতি জুলুম করে থাকলে তাকে ক্ষতিপূরণ দেই বা তার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেই।
● শিরক-বিদআত, অপসংস্কৃতি, পাপ-পঙ্গিলতা ও অশ্লীলতা-নোংরামি থেকে ফিরে আসি।
● ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য মহান রবের কাছে প্রত্যেকেই কায়মনোবাক্যে ইখলাসের সাথে দুআ করি।
● সেই সাথে আধুনিক স্বাস্থ্য নির্দেশনা চলি।

মনে রাখতে হবে, বিপদাপদ দ্বারা আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দাদের গুনাহ মোচন করেন এবং আখিরাতে মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। আর কোন ঈমানদার মহামারীতে মারা গেলে তাকে আখিরাতে শাহাদাতের মর্যাদা দান করেন।
সুতরাং হতাশা ও আতঙ্ক নয়। বরং কর্তব্য হল, ধৈর্যের সাথে শরিয়ত সম্মত পদ্ধতি অনুযায়ী রোগ-ব্যাধি থেকে বাঁচার চেষ্টা করা।
আল্লাহ আমাদেরকে শিরক-বিদআত থেকে বাঁচান পাপরাশি ক্ষমা করুন এবং সব ধরণের বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করুন।

আমিন।

▬▬▬◄❖►▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব

➥ লিংকটি কপি অথবা প্রিন্ট করে শেয়ার করুন:
পুরোটা দেখুন

আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব। দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।
এছাড়াও পড়ে দেখুন
Close
Back to top button