ইসলামে ইবাদত বা দাসত্বের তাৎপর্য
প্রশ্নঃ ইসলামে উবুদিয়্যত তথা আল্লাহর দাসত্ব ও মানুষের দাসত্বের স্বরূপ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবেন আশা করছি।
উত্তরঃ
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্র জন্য।
মুসলমানএকমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত করবে, তাঁরই দাসত্ব করবে।এব্যাপারেতিনিতাঁরকিতাবেস্পষ্টনির্দেশদিয়েছেনএবংতাঁরদাসত্বপ্রতিষ্ঠা করারজন্যইতিনিরাসূলদেরকেপ্রেরণকরেছেন। তিনিবলেন,
وَلَقَدْبَعَثْنَافِيكُلِّأُمَّةٍرَّسُولاًأَنِاعْبُدُواْاللَّهَوَاجْتَنِبُواْالطَّاغُوتَ
“অবশ্যই আমিপ্রত্যেকজাতিরমধ্যেরাসূলপাঠিয়েছিএ নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরাআল্লাহ্র উপাসনা (দাসত্ব) কর এবংতাগুতকে বর্জনকর।”[সূরানাহল, ১৬:৩৬]عُبُودِيَّة (উবুদিয়্যাহ্) শব্দটিتَعْبِيْدٌ (তা’বীদ) শব্দ হতে উদ্ভূত। কোন একটি অমসৃণ রাস্তাকে পদদলিত করে চলার উপযুক্ত করা হলে তখন বলা হয়: عَبَّدتُّالطَّرِيْقَ। আল্লাহ্র জন্য বান্দার দাসত্বের দুটি অর্থ রয়েছে। একটি ‘আম’ তথা সাধারণ। অপরটি ‘খাস্’ তথা বিশেষ। যদিعُبُودِيَّة দ্বারা مُعَبَّد তথা করায়ত্ব-অধীন-বশীভূত এ অর্থ উদ্দেশ্য নেয়া হয়, তখন এ দাসত্বের পরিধি অতি ব্যাপক। মহাবিশ্বে আল্লাহ্র যত সৃষ্টি রয়েছে সকল সৃষ্টি এ দাসত্বের আওতায় এসে যায়। চলন্ত-স্থির, শুষ্ক-ভিজা, বুদ্ধিমান-নির্বোধ, মুমিন-কাফির, সৎকর্মশীল-পাপী… সকলেই আল্লাহ্র সৃষ্ট, তাঁর বশীভূত এবং তাঁর পরিচালনাধীন।একটা নির্ধারিত সীমানায় এসে সকলকে থেমে যেতে হয়। আর যদি عبد (আবদ) দ্বারা আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধের আজ্ঞাবহ, তাঁর দাসত্ব-স্বীকারকারী কাউকে উদ্দেশ্য করা হয় তবে এ দাসত্বের আওতায় শুধু মুমিনগণ পড়ে, কাফেরেরা নয়। কেননা মুমিনরাই হলো আল্লাহ্র প্রকৃত দাস। যারা একমাত্র তাঁকে তাদের প্রতিপালক হিসেবে মানে এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত (দাসত্ব) করে। তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করে না। যেমনটা আল্লাহ্ তায়ালা ইবলিসের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন:
قَالَرَبِّبِمَاأَغْوَيْتَنِيلَأُزَيِّنَنَّلَهُمْفِيالْأَرْضِوَلَأُغْوِيَنَّهُمْأَجْمَعِينَ (39) إِلَّاعِبَادَكَمِنْهُمُالْمُخْلَصِينَ (40) قَالَهَذَاصِرَاطٌعَلَيَّمُسْتَقِيمٌ (41) إِنَّعِبَادِيلَيْسَلَكَعَلَيْهِمْسُلْطَانٌإِلَّامَنِاتَّبَعَكَمِنَالْغَاوِينَ (42) سورة الحجر
“সে (ইবলিস) বললো, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করলেন, তার জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মকে অবশ্যই শোভনীয় করে তুলব এবং তাদের সকলকেই আমি বিপথগামী করে ছাড়ব। তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ দাসগণ(বান্দাগণ) ছাড়া। তিনি (আল্লাহ্) বললেন: এটাই আমার নিকট পৌঁছার সরল পথ। বিভ্রান্তদের মধ্য হতে যারা তোমার অনুসরণ করবে তারা ছাড়া আমার (একনিষ্ঠ) দাসদের উপর তোমার কোন আধিপত্য থাকবে না।”[সূরা হিজর ৩৯-৪২]আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন যে প্রকার দাসত্ব তথা ইবাদতের আদেশ নাযিল করেছেন সেটা হলো- “এমন একটি বিষয় যা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের পছন্দনীয় সকল প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং তার অপছন্দনীয় সবকিছুকে বের করে দেয়। ইবাদতের এ পরিচয়ের আওতায় শাহাদাতাইন (কালিমা ও রিসালাতের দুইটি সাক্ষ্যবাণী), সালাত, হজ্ব, সিয়াম, জিহাদ, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধ, আল্লাহ্র প্রতি ঈমান, ফেরেশতা-রাসূল-শেষ বিচারের দিনের প্রতি ঈমান…ইত্যাদি সবকিছু অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এ ইবাদতের মূল ভিত্তি হলো ‘ইখলাস’। অর্থাৎ বান্দাহ্ সকল কাজের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তি কামনা করবে। ইরশাদ হচ্ছে- “আর সে আগুন থেকে রক্ষা পাবে; যে পরম মুত্তাকী।যে স্বীয় সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে। তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদান হিসেবে নয়। বরং তার মহান প্রতিপালকের সন্তোষ লাভের প্রত্যাশায় এবং সেতো অচিরেই সন্তোষ লাভ করবে।”[সূরা লাইল, ৯২:১৭-২১] সুতরাং একনিষ্ঠতা (ইখলাস) এবংবিশ্বস্ততা থাকতে হবে। এ গুণদুটি প্রকাশ পাবেএকজন মুমিনেরআল্লাহ্র আদেশ পালন, তাঁর নিষেধ থেকে বিরত থাকা, তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা, অক্ষমতা ও অলসতা ত্যাগ করা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে সংযম অবলম্বন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। আল্লাহ্ বলেন- “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্কে ভয় করো এবং যারা সত্যবাদী (কথা ও কাজে) তাদের সঙ্গে থাকো।”[সূরা তাওবাহ্, ৯:১১৯] এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরইত্তেবা(অনুসরণ)করতে হবে।অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত বিধান (শরিয়ত) অনুযায়ী ইবাদত পালন করবে। মাখলুকের মনমত অথবা নতুন কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে আল্লাহর ইবাদত করবে না। এটাই হলো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইত্তেবা বা অনুসরণের মর্মার্থ।সুতরাংএকনিষ্ঠতা, বিশ্বস্ততা বা অকপটতা এবং ইত্তেবায়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এ তিনটি উবুদিয়্যাহ্ বা আল্লাহর দাসত্বের অনিবার্য উপসর্গ।এ তিনটির সাথে যা কিছু সাংঘর্ষিক সেগুলো ‘মানুষের দাসত্ব’। রিয়া বা লৌকিকতা‘মানুষের দাসত্ব’।শির্ক‘মানুষের দাসত্ব’।আল্লাহ্র নির্দেশ ত্যাগ করে, আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করা‘মানুষের দাসত্ব’। এভাবে যে ব্যক্তি তার খেয়ালখুশিকে আল্লাহ্র আনুগত্যের উপরে প্রাধান্য দেবে সে আল্লাহর দাসত্বের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে এবং সরল পথ (সিরাতুল মুস্তাকীম) থেকে ছিটকে পড়বে। তাইতো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “দিনার ও দিরহামের পূজারি ধবংস হোক। ধবংস হোক কারুকাজের পোশাক ও মখমলের বিলাসী। যদি তাকে কিছু দেওয়া হয় সে সন্তুষ্টথাকে; আর না দেওয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়।সে মুখ থুবড়ে পড়ুক অথবা মাথা থুবড়ে পড়ুক। সে কাটা বিদ্ধ হলে কেউ তা তুলতে না পারুক।” “আল্লাহ্র দাসত্ব” ভালোবাসা, ভয়, আশা ইত্যাদিকে শামিল করে। সুতরাং বান্দা তার রবকে ভালোবাসবে, তাঁর শাস্তিকে ভয় করবে, তাঁর সওয়াব ও করুণার প্রত্যাশায় থাকবে। এই তিনটি আল্লাহর দাসত্বেরমৌলিক উপাদান। আল্লাহ্র দাস হওয়া বান্দার জন্য সম্মানজনক;অপমানকরনয়। কবি বলেছেন,
আপনার সম্বোধন ‘হে আমার বান্দারা’ এর অন্তর্ভুক্ত হতে পেরে এবং আহমাদকে আমার নবী মনোনীত করাতে আমার মর্যাদা আরো বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন আমিআকাশেরনক্ষত্রকে পায়ের নীচে মাড়িয়ে চলেছি।মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে তার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমাদের নবীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
মূল — https://islamqa.info/