প্রশ্নঃ মিথ্যা বলার কারণে কি কি শাস্তি দেওয়া হবে?
উত্তরঃ মানুষকে হাসানোর জন্য যারা মিথ্যা বলে তাদের পরিনতি
অনেকে ধারণা করে যে হাসি-রসিকতায় মিথ্যা বলা বৈধ। আর এ ধারণা থেকেই বিশ্ব ধোঁকা দিবস বা এপ্রিল ফুলের জন্ম।
এটা ভুল ধারণা, এর কোন ভিত্তি নেই ইসলাম ধর্মে। রসিকতা হোক কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায় হোক, মিথ্যা সর্বাবস্থায় হারাম।
বাহয ইবনু হাকীম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন,
আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ মানুষকে হাসানোর জন্য যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস।
জামে’ আত-তিরমিযীঃ অধ্যায় ৩৬ (কিতাবুল যুহুদ), হাদীস ১২। ]
ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, “আমি রসিকতা করি ঠিক, তবে সত্য ব্যতীত কখনো মিথ্যা বলি না।” (তাবরানি ফিল মুজামুল কাবির : ১২/৩৯১, সহিহ আল-জামে হা/২৪৯৪)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম একদা বলল, হে আল্লাহ রাসূল! আপনি তো আমাদের সঙ্গে রসিকতা করেন। তিনি (রাসূল সা.) বললেন, ‘আমি সত্য ভিন্ন কিছু বলি না।’ (তিরমিজি, হা/১৯৯০)
আব্দুর রহমান ইবনে আবি লায়লা রহ. বলেন,
রাসূল সা. এর সাহাবিগণ বলেছেন যে, তারা রাসূল সা. সঙ্গে কোন সফরে ছিল, তাদের একজন ঘুমিয়ে পড়লে অপর কেউ তার তীর নিয়ে নেয়,
লোকটি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে ভীত হয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে সবাই হেসে দিল। রাসূল সা. বললেন, তোমরা হাসলে কেন?
তারা বলল, কিছু হয়নি। তবে আমি তার তীরটি নিয়েছিলাম আর এতেই সে ঘাবড়ে গেছে। রাসূল সা. বললেন, “কোন মুসলিমের জন্য অন্য কোন মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়।”
(আবুদাউদ হা/৫০০৪, আহমদ হা/২২৫৫৫, অনুবাদ আহমদ থেকে, সহিহ আল-জামে হা/৭৬৫৮)
অপর এক হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন,
“তোমাদের কেউ কারো আসবাব পত্র ইচ্ছায় বা রসিকতায় ধরবে না, কেউ কারোটা ধরে থাকলে তার উচিত তাকে তা ফেরৎ দেয়া।”
(আবুদাউদ হা/৫০০৩, তিরমিজি হা/২১৬০, সহিহ আল-জামে হা/৭৫৭৮, হাদিসটি হাসান)
মিথ্যা বলার কুফল এবং এর পরিণতি সম্পর্কে হাদিসে এসেছে,
আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“তোমরা মিথ্যা পরিহার করবে। কেননা, মিথ্যা মানুষকে খারাপ কাজে লিপ্ত করে, আর অপকর্ম মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।
যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যা বলা শুরু করে, তখন বার-বার মিথ্যা বলার কারণে, আল্লাহ্র নিকটে তার নামটি ‘মিথ্যাবাদী’ হিসাবে লিখিত হয়।
এরপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা সত্য কথা বলবে। কেননা, সত্য মানুষকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যায় এবং কল্যাণ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করায় ।
আর যখন কোন ব্যক্তি সত্য কথা বলতে থাকে, তখন সব সময় সত্য কথা বলার কারণে, আল্লাহ্র নিকটে তার নামটি ‘সত্যবাদী’ হিসাবে লিখিত হয়।”
[সূনান আবু দাউদ (ইফাঃ), হাদিস নং-৪৯০৪]
সুতরাং আমাদের উচিত হবে মিথ্যা সর্বাবস্থায় পরিহার করা এবং মিথ্যার কোন আশ্রয় আমাদের মুসলিম জীবনে স্থান না দেওয়া।
এবং এর কুফল ও পরিণাম সম্পর্কে সকলকে সর্তক ও সংশোধন করে দেয়া।
মিথ্যা বলা অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া একটি মারাত্মক অপরাধ।
অনুমান ভিত্তিক কথা থেকে দূরে থাকুনঃ
———————————
কোন বিষয়ে নিশ্চিত জানাশোনা না থাকা সত্ত্বেও সে বিষয়ে অনুমান ভিত্তিক কোন কথা বলা সত্যিই অপরাধ এবং তা অধিকাংশ সময় মিথ্যা হতেই বাধ্য।
অনুমান ভিক্তিক করে আমরা অনেক কথাই বলে থাকি । যেমন আপনার কেউ Mobail থেকে call টা ধরছে না, আপনি হুট করে একটা মন্তব্য করে বসলেন হয়ত অমুক কাজ করছে, ইত্যাদি।
এইব্যপারে মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ﴾ [الاسراء: ٣٦]
অর্থাৎ যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হইয়ো না। (সূরা ইসরা ৩৬ আয়াত)
*আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:
«قُتِلَ الْـخَرَّاصُوْنَ»
‘‘(অনুমান ভিত্তিক) মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক’’। (যারিয়াত : ১০)
প্রত্যেকটি কথা বলার আগে চিন্তাভাবনা করে বলুনঃ
———————————-
মহান আল্লাহ বলেনঃ
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ﴾ [ق: ١٨]
অর্থাৎ মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করুক না কেন তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।
(ক্বাফ ১৮ আয়াত)
মিথ্যাবাদি রুপে হাশরের ময়দানে পরিচিতিলাভঃ
———————————–
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্’ঊদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِيْ إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِيْ إِلَى الْـجَنَّةِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيْقًا،
وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِيْ إِلَى الْفُجُوْرِ، وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِيْ إِلَى النَّارِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا.
‘‘তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো। কারণ, সত্য পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ।
কোন ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে এবং সর্বদা সত্যের অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট সত্যবাদী হিসেবেই লিখিত হয়।
আর তোমরা মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো। কারণ, মিথ্যা পাপাচারের রাস্তা দেখায় আর পাপাচার জাহান্নামের রাস্তা।
কোন ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বললে এবং সর্বদা মিথ্যার অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মিথ্যাবাদী রূপেই লিখিত হয়’’।
(মুসলিম ২৬০৭)
মিথ্যুকদের শাস্তিঃ
———————————-
সামুরাহ্ বিন্ জুন্দুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: ’’একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে নিজ স্বপ্ন বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: গত রাত আমার নিকট দু’ জন ব্যক্তি এসেছে। তারা আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললো: চলুন, তখন আমি তাদের সাথেই রওয়ানা করলাম। যেতে যেতে আমরা এমন এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছুলাম যে চিত হয়ে শায়িত। অন্য আরেক জন তার পাশেই দাঁড়িয়ে একটি মাথা বাঁকানো লোহা হাতে। লোকটি বাঁকানো লোহা দিয়ে শায়িত ব্যক্তির একটি গাল, নাকের ছিদ্র এবং চোখ ঘাড় পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলছে। এরপর সে উক্ত ব্যক্তির অন্য গাল, নাকের ছিদ্র এবং চোখটিকেও এমনিভাবে ছিঁড়ে ফেলছে। লোকটি শায়িত ব্যক্তির এক পার্শ্ব ছিঁড়তে না ছিঁড়তেই তার অন্য পার্শ্ব পূর্বাবস্থায় ফিরে যাচ্ছে এবং লোকটি শায়িত ব্যক্তিটির সাথে সে ব্যবহারই করছে যা পূর্বে করেছে। ফিরিশ্তাদ্বয় উক্ত ঘটনার ব্যাখ্যায় বলেন: উক্ত ব্যক্তির দোষ এই যে, সে ভোর বেলায় ঘর থেকে বের হয়েই মিথ্যা কথা বলে বেড়ায় যা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে’’। (বুখারী ৭০৪৭; মুসলিম ২২৭৫)
বিশেষ আফসোসের ব্যাপার এই যে, অনেক রসিক ব্যক্তি শুধুমাত্র মানুষকে হাসানোর জন্যই মিথ্যা কথা বলে থাকেন। তাতে তার ইহলৌকিক অন্য কোন ফায়েদা নেই। অথচ সে অন্যকে ফুর্তি দেয়ার জন্যই এমন জঘন্য কাজ করে থাকে।
’হিযাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
وَيْلٌ لِلَّذِيْ يُحَدِّثُ بِالْـحَدِيْثِ، لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ فَيَكْذِبُ، وَيْلٌ لَهُ، وَيْلٌ لَهُ.
‘‘অকল্যাণ হোক সে ব্যক্তির যে মানুষকে হাসানোর জন্যই মিথ্যা কথা বলে। অকল্যাণ হোক সে ব্যক্তির; অকল্যাণ হোক সে ব্যক্তির’’।(তিরমিযী ২৩১৫)
মিথ্যা কথা বলা মুনাফিকী চরিত্রঃ
——————————–
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে, সে খাঁটি মুনাফিক গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তির মাঝে তার মধ্য হতে একটি স্বভাব থাকবে, তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকদের একটি স্বভাব থেকে যাবে। [সে স্বভাবগুলি হল,]
১। তার কাছে আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে।
২। সে কথা বললে মিথ্যা বলে।
৩। ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং
৪। ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীল ভাষা বলে।’’
(বুখারী ও মুসলিম)