রোজা / সিয়াম

চাঁদ উঠার বিভিন্ন উদয়স্থল সংক্রান্ত মতভেদ কি বিবেচনাযোগ্য? এ ব্যাপারে অমুসলিম দেশে অবস্থানরত মুসলিম কমিউনিটির করণীয়

প্রশ্ন: আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে বসবাসরত কিছু মুসলিম ছাত্র। প্রতি বছর রমজান মাসের শুরুতে আমরা একটি সমস্যার মুখোমুখি হই। এ সময় স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটি তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১. প্রথম দল: তারা যে দেশের স্থায়ী বাসিন্দা সে দেশে চাঁদ দেখার খবরের ভিত্তিতে রোজা শুরু করে। ২. দ্বিতীয় দল: যারা সৌদি আরবে রোজা রাখা শুরু হলে সিয়াম পালন শুরু করে। ৩. তৃতীয় দল: যারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মুসলিম ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নতুন চাঁদ দেখার খবর পৌঁছলে রোজা রাখে। এ ছাত্র ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে চাঁদ দেখার দায়িত্ব পালন করে থাকে। তারা দেশের কোন এক স্থানে চাঁদ দেখলে সে খবর বিভিন্ন ইসলামিক সেন্টারে পৌঁছে দেয়। তাদের খবরের ভিত্তিতে গোটা যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান একই দিন রোজা পালন শুরু করে; যদিও শহরগুলোর মাঝে দূরত্ব অনেক। এক্ষেত্রে সিয়াম পালন, চাঁদ দেখা ও এ সংক্রান্ত খবরের ব্যাপারে কারা বেশি অনুসরণযোগ্য? দয়া করে এ ব্যাপারে আমাদেরকে ফতোয়া দিন; আল্লাহ আপনাদেরকে সওয়াব দিবেন।

উত্তরঃ সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। এক: স্থানভেদে নতুন চাঁদের ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল থাকার বিষয়টি ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি দ্বারা অবধারিতভাবে জ্ঞাত।এ ব্যাপারে কোন আলেম দ্বিমত করেন নি। সে ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল কি বিবেচনাযোগ্য; নাকি বিবেচনাযোগ্য নয়- তা নিয়ে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। দুই: ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল ও তা বিবেচনাযোগ্য না হওয়ার বিষয়টিতাত্ত্বিক মাসয়ালা।এতে ইজতিহাদের সুযোগ রয়েছে। ইলম ও দ্বীনদারিরবিবেচনায়যোগ্য আলেমদের এ ব্যাপারে মতভেদ করার অবকাশ আছে। এটি এমন একটি গ্রহণযোগ্য মতভেদ যে ব্যাপারে সঠিক মতপ্রদানকারী (মুজতাহিদ) দুইবার সওয়াব পাবেন- ইজতিহাদ করার সওয়াব ও সঠিক মত প্রদান করার সওয়াব এবং ভুল মত প্রদানকারী (মুজতাহিদ)ও ইজতিহাদ করার জন্যএকটি সওয়াব পাবেন। এই মাসয়ালাতে আলেমগণ দুটি মত ব্যক্ত করেছেন:

-তাঁদেরকেউকেউভিন্নভিন্নউদয়স্থলবিবেচনাকরেছেন

-আর কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করেননিতাদের উভয়পক্ষ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলিল দিয়েছেন। এমনকি একই দলিলউভয় পক্ষ তার মতের পক্ষেব্যবহার করেছেন। কারণ সে দলিলটি উভয় মতের পক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করা যায়। যেমনআল্লাহ্‌র তাআলার বাণী:

(يسألونكعنالأهلةقلهيمواقيتللناسوالحج )[ 2 البقرة: 189]

“লোকেরা আপনাকে নতুন মাসের চাঁদসম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদেরকে বলে দিনএটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের)এবং হজ্জেরসময় নির্ধারণ করার জন্য।” [২ সূরা আল-বাক্বারা:১৮৯]এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম এরবাণী:

( صوموالرؤيتهوأفطروالرؤيته ) الحديث

“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা শুরু কর এবং সেটা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা ছেড়ে দাও।”[সহিহ বুখারী(১৯০৯)ও সহিহ মুসলিম (১০৮১)]উভয় পক্ষের এ মতভেদের কারণ হল প্রত্যেক পক্ষদলিলটিকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বুঝেছেন এবং মাসয়ালা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদাপথ অনুসরণকরেছেন।তিন: জ্যোতির্বিদ্যার গণনার মাধ্যমে নতুনচাঁদ সাব্যস্তকরণ ও এ ব্যাপারে বর্ণিত কুরআন-হাদিসের দলিলগুলো আলেমগণের পরিষদ পর্যালোচনা করেছেন এবংতাঁরাএব্যাপারেপূর্ববর্তী আলেমগণেরসকল বক্তব্য অবগত হয়েছেন।পরিশেষে তাঁরা সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, শরয়ি বিধিবিধান পালনের জন্য নতুন চাঁদ সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবগ্রহণযোগ্য নয়। তাঁদের দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম এর বাণী:

( صوموالرؤيتهوأفطروالرؤيته ) الحديث

“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজারাখ এবং তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা ছাড়।”[সহিহ বুখারী (১৯০৯)ও সহিহ মুসলিম (১০৮১)]তিনি আরো বলেছেন:

(لاتصومواحتىتروهولاتفطرواحتىتروه ) الحديث

“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) না-দেখা পর্যন্ত রোজা রেখো না এবং তা (নতুন চাঁদ) না-দেখা পর্যন্ত রোজা ছেড়ে দিও না।”[মালিক (৬৩৫)] এবং এই অর্থের আরো অন্যান্য দলীল। গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির অভিমত হচ্ছে- অমুসলিম সরকার কর্তৃক শাসিত দেশে বসবাসকারী মুসলমানদের জন্য নতুন চাঁদ সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে এ ধরনের মুসলিম ছাত্র ইউনিয়ন (অথবা অন্য যে কোন প্রতিষ্ঠান যারা মুসলিমকমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করে) মুসলিম সরকারের স্থলাভিষিক্ত হবে। ইতিপূর্বে উল্লেখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এই ছাত্র ইউনিয়নের ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করা অথবা না-করা এ দুটো অভিমতের যে কোন একটি বেছে নেয়ার অধিকার রয়েছে। এরপর তারা বাছাইকৃত সে অভিমতকে সে দেশের সকল মুসলিমের উপর প্রয়োগ করবেন। ছাত্র ইউনিয়নের এই সাধারণ প্রজ্ঞাপন মেনে নেয়া সেখানকার মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক- ঐক্যের স্বার্থে, যথাসময়ে সিয়াম শুরু করার স্বার্থে এবং মতভেদ ও বিভ্রান্তি এড়িয়ে চলার নিমিত্তে। এ ধরনের দেশে যারা বাস করে তাদের প্রত্যেকের কর্তব্য হলো- নিজ নিজ এলাকায় নতুন চাঁদ দেখা।যদি তাদের মধ্য থেকে এক বা একাধিক ছিকা(নির্ভরযোগ্য) ব্যক্তিনতুনচাঁদদেখেতবেতারারোজাপালনশুরু করবেএবংছাত্র ইউনিয়নকেওসে সংবাদ দিবেযাতেতারাসবারজন্য প্রজ্ঞাপন জারী করতেপারে। এই পদ্ধতিটিমাসশুরুসাব্যস্ত হওয়ারক্ষেত্রে প্রযোজ্য।আর মাস শেষ হওয়ার ক্ষেত্রে শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ দেখেছে এই মর্মে দুইজন আদেল(দ্বীনদার) ব্যক্তিরসাক্ষ্য আবশ্যক হবে। অন্যথায় রমজান মাস ত্রিশদিন পূর্ণ করতে হবে।এর দলীল হচ্ছে- রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহুআলাইহিওয়া সাল্লামএর বাণী:

( صوموالرؤيتهوأفطروالرؤيتهفإنغمعليكمفأكملواالعدةثلاثينيوماً )

“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা পালন কর এবং তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা ছাড়। আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে তা (নতুন চাঁদ) দেখা না যায় তবে ত্রিশদিন পূর্ণ কর।” আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

➥ লিংকটি কপি অথবা প্রিন্ট করে শেয়ার করুন:
পুরোটা দেখুন
এছাড়াও পড়ে দেখুন
Close
Back to top button