কসম এর কাফ্ফারা
প্রশ্ন: আল্লাহ্র নামে কসম (শপথ) সংক্রান্ত আমার একটি প্রশ্ন আছে। সেটা হচ্ছে, আমি আল্লাহ্র নামে শপথ করেছি যে, আমি অমুক স্থানে যাব না। কিন্তু, কসম করার এক সপ্তাহ পরে আমি সে স্থানে গিয়েছি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, শাওয়ালের ছয় রোযার মধ্যে আমি তিনটি রোযা রাখব। এ তিনটি রোযা কি কসমের কাফ্ফারা হিসেবে গণ্য হবে? কিংবা কি? আল্লাহ্ আপনাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন।
উত্তর:
এক: আমরা প্রশ্নকারী ভাই এর প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করব:
১। প্রত্যেক মুসলিমের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে, যখন তখন ঐ সব বিষয়ে কসম করা থেকে নিজেকে হেফাযত করা যেসব বিষয় আল্লাহ্র নামে কসম করার উপযুক্ত নয়। যেহেতু আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “তোমরা তোমাদের শপথগুলোকে হেফাযত কর।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৮৯]
শাইখ মুহাম্মদ বিন উছাইমীন (রহঃ) বলেন:
মৌলিক বিধান হচ্ছে- বেশি বেশি শপথ না করা। যেহেতু আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “তোমরা তোমাদের শপথগুলোকে হেফাযত কর।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৮৯] এ আয়াতের ব্যাখ্যায় কোন কোন আলেম বলেন: তোমরা বেশি বেশি শপথ করো না। নিঃসন্দেহে এটি উত্তম, নিরাপদ ও দায় মুক্ত থাকার জন্য শ্রেয়।[আল-শারহুল মুমতি (১৫/১১৭)]
২। যে স্থানে না-যাওয়ার জন্য আপনি শপথ করেছেন সেটি যদি আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী নিষিদ্ধ স্থান হয়; যেখানে যাওয়া আপনার জন্য বৈধ নয়; তাহলে সে শপথ পূর্ণ করা এবং সেখানে না-যাওয়া আপনার উপর ফরয। আর যদি সে স্থানে যাওয়া আপনার উপর ফরয হয়ে থাকে (যেমন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, কোন আত্মীয়কে দেখতে যাওয়া) তাহলে এ শপথ ভঙ্গ করা আপনার উপর ফরয; যদি যাওয়াটা আপনার উপর ফরয হয়ে থাকে। আর যদি সেখানে যাওয়াটা মুস্তাহাব হয়ে থাকে, তাহলে শপথ ভঙ্গ করাও মুস্তাহাব। আর যদি সে স্থানে যাওয়াটা মুবাহ (বৈধ) হয়ে থাকে তাহলে আপনি দেখুন আপনার দ্বীনদারি ও দুনিয়াদারির জন্য কোনটা উত্তম, এবং আপনার রবের ভীতি তৈরীতে কোনটা উপযোগী সেটা করুন। যদি আপনার সে স্থানে যাওয়াটা উত্তম ও তাকওয়া পয়দাকারী হয় তাহলে আপনি সে স্থানে যান এবং আপনার শপথের কাফফারা দিয়ে দিন। আর সে রকম না হলে আপনি সে স্থানে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।
আব্দুর রহমান বিন সামুরা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি আপনি কোন একটি বিষয়ে শপথ করেন, এরপর দেখতে পান যে, অন্য বিষয়টি শপথকৃত বিষয়ের চেয়ে উত্তম তাহলে আপনি উত্তমটি পালন করুন এবং আপনার শপথ ভঙ্গের কাফফারা পরিশোধ করে দিন।”[সহিহ বুখারী (৬৩৪৩) ও সহিহ মুসলিম (১৬৫২)]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোন এক বিষয়ে শপথ করে ফেলার পর অন্য বিষয়টিকে উত্তম দেখতে পায় তাহলে সে যেন তার শপথের কাফফারা আদায় করে দেয় এবং যেটা উত্তম সেটাই করে।”[সহিহ মুসলিম (১৬৫০)]
আল-মাওসুআ’ আল-ফিকহিয়্যা গ্রন্থে(৮/৬৩) এসেছে-
বির্রুল ইয়ামিন (শপথ) এর মানে হচ্ছে- শপথের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত হওয়া এবং যা শপথ করা হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “তোমরা আল্লাহ্কে তোমাদের জামিনদার করে শপথ দৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করো না। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ্ তা জানেন।”[সূরা নাহল, আয়াত: ৯১]
কোন ফরয আমল করা কিংবা হারাম কাজ পরিহার করার ক্ষেত্রে শপথ করা হলে তখন শপথ বাস্তবায়ন করা ফরয। তাই কোন নেককাজ করার শপথ করা হলে সে নেক কাজটি পালন করা হচ্ছে শপথ পূর্ণ করা। এক্ষেত্রে শপথ ভঙ্গ করা হারাম। আর কোন ফরয আমল পরিত্যাগ করা কিংবা কোন গুনাহর কাজ করার শপথ করা হলে এটি বদ শপথ; এ ধরণের শপথ ভঙ্গ করা ফরয। আর যদি কোন নফল আমল করার শপথ করে যেমন নফল নামায পড়া কিংবা নফল সদকা করা; সেক্ষেত্রে শপথ পূর্ণ করা মুস্তাহাব এবং শপথ ভঙ্গ করা মাকরুহ।
আর যদি কোন নফল আমল পরিত্যাগ করার শপথ করে তাহলে এটি মাকরুহ শপথ এবং এ শপথ পূর্ণ করাও মাকরুহ। বরং এ ক্ষেত্রে সুন্নত হচ্ছে- শপথ ভঙ্গ করা। আর যদি কোন মুবাহ কাজের ক্ষেত্রে শপথ হয় তাহলে সে শপথ ভঙ্গ করাও মুবাহ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি আপনি কোন একটি বিষয়ে শপথ করেন, এরপর দেখতে পান যে, অন্য বিষয়টি শপথকৃত বিষয়ের চেয়ে উত্তম তাহলে আপনি উত্তমটি পালন করুন এবং আপনার শপথ ভঙ্গের কাফফারা পরিশোধ করে দিন।”[সমাপ্ত]
৩. আপনি শপথ ভঙ্গ করার বদলে তিনটি রোযা রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটি নাজায়েয। তবে আপনি যদি দশজন মিসকীনকে খাবার দিতে কিংবা পোশাক দিতে অক্ষম হন তাহলে সেটা করতে পারেন। কারণ শপথ ভঙ্গের কাফ্ফারা হচ্ছে- দশজন মিসকীনকে খাদ্য দেয়া কিংবা পোশাক দেয়া কিংবা একজন ক্রীতদাস মুক্ত করা। যে ব্যক্তির এগুলো কোনটি করার সামর্থ্য নেই সে তিনদিন রোযা রাখবে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “তোমাদের ইয়ামীনে লাগু (বৃথা শপথ) এর জন্য আল্লাহ্ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু যেসব শপথ তোমরা ইচ্ছে করে কর সেগুলোর জন্য তিনি তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। এর কাফ্ফারা হচ্ছে- দশজন মিসকীনকে মধ্যম ধরণের খাদ্য দান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও, বা তাদেরকে বস্ত্রদান, কিংবা একজন দাসমুক্তি। অতঃপর যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করলে এটাই তোমাদের শপথের কাফ্ফারা। আর তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করো। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।”[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৮৯]
দেখুন: 45676 নং প্রশ্নোত্তর।
দুই: আপনার প্রশ্নের আরেকটি অংশ হচ্ছে, আপনি শপথের কাফ্ফারার রোযা শাওয়াল মাসে রাখতে চাচ্ছেন এবং এ রোযাগুলোকে ছয় রোযার মধ্যে গুণতে চাচ্ছেন। বর্ণিত আছে যে, শাওয়ালের রোযার ফযিলত গোটা বছর ফরয রোযা রাখার সমান। তাই আমরা বলব: যদি আপনি মিসকীনকে খাদ্য দিতে ও পোশাক দিতে অক্ষম হওয়ায় আপনার দায়িত্বে রোযা রাখাই অবধারিত হয়ে যায় সেক্ষেত্রে আপনি কাফ্ফারার রোযাগুলোকে শাওয়ালের ছয় রোযার মধ্যে হিসাব করতে পারবেন না। কেননা, নফল রোযার নিয়ত ও ফরয রোযার নিয়ত একত্রে করা জায়েয নেই। কাফ্ফারার রোযার জন্য স্বতন্ত্র বিশেষ নিয়তের প্রয়োজন রয়েছে; যেমনিভাবে শাওয়ালের ছয় রোযার জন্যেও নিয়তের প্রয়োজন। অতএব, কাফ্ফারার জন্য আপনি যে তিনটি রোযা রাখবেন সে রোযাগুলোকে শাওয়ালের ছয় রোযার মধ্যে হিসাব করা যাবে না।
স্থায়ী কমিটিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:
শাওয়ালের ছয় রোযা, আশুরার রোযা ও আরাফার দিনের রোযা কি শপথ ভঙ্গের রোযা হিসেবে আদায় হবে? যদি ব্যক্তি শপথের সংখ্যা নির্ধারণ করতে অক্ষম হয়?
উত্তরে তারা বলেন: শপথের কাফ্ফারা হচ্ছে, একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করা কিংবা দশজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়ানো কিংবা তাদেরকে পোশাক দেয়া। যদি এগুলোর কোনটি কেউ করতে না পারে তাহলে সে প্রতিটি শপথ ভঙ্গের বদলে তিনদিন রোযা রাখবে।
আপনি বলেছেন যে, আপনি শপথের সংখ্যা হিসাব করতে অক্ষম: আপনার কর্তব্য হচ্ছে, কাছাকাছি সংখ্যা হিসাব করার চেষ্টা করা। এরপর এ শপথগুলোর মধ্যে যেগুলো আপনি ভঙ্গ করেছেন সেগুলোর কাফ্ফারা আদায় করা। এভাবে করা আপনার জন্য যথেষ্ট হবে, ইনশাআল্লাহ্।
আশুরার রোযা, আরাফার রোযা ও শাওয়ালের ছয় রোযা শপথ ভঙ্গের কাফ্ফারার রোযা হিসেবে আদায় হবে না; তবে ব্যক্তি যদি নিয়ত করে যে, এটা কাফ্ফারার রোযা; নফল রোযা নয় তাহলে আদায় হবে।
শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায, শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, শাইখ আব্দুল্লাহ্ বিন গাদইয়ান।[ফাতাওয়াল লাজনাহ্ দায়িমাহ্ (২৩/৩৭,৩৮)]
শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
প্রশ্নকারী বোন উল্লেখ করেছেন যে, তিনি শপথ করেছেন; এখন তিনি তিনদিন রোযা রেখে এ শপথের কাফ্ফারা আদায় করতে চাচ্ছেন। আমার জন্যে কি এ রোযাগুলো শাওয়ালের ছয় রোযার সাথে রাখা জায়েয হবে? অর্থাৎ আমি ছয়দিন রোযা রাখব?
উত্তরে তিনি বলেন:
শপথকারী শপথ ভঙ্গ করলে তার জন্য রোযা দিয়ে কাফ্ফারা আদায় করা জায়েয হবে না; যদি না তিনি দশজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়ানো কিংবা তাদেরকে পোশাক দেয়া কিংবা একজন কৃতদাস মুক্ত করার সামর্থ্য না রাখেন। কেননা আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “এর কাফ্ফারা হচ্ছে- দশজন মিসকীনকে মধ্যম ধরণের খাদ্য দান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও, বা তাদেরকে বস্ত্রদান, কিংবা একজন দাসমুক্তি। অতঃপর যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করলে এটাই তোমাদের শপথের কাফ্ফারা।”[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৮৯]
সাধারণ মানুষের কাছে একটা বিষয় মশহুর হয়ে গেছে যে, শপথ ভঙ্গ করার কাফ্ফারা তিনদিন রোযা রাখা; চাই সে ব্যক্তি মিসকীনকে খাদ্য দেয়া কিংবা পোশাক দেয়া কিংবা দাস মুক্ত করার সামর্থ্য রাখুক কিংবা না-রাখুক Ñ এটি ভুল। বরং যে শপথভঙ্গকারী দশজন মিসকীনকে খাদ্য দেয়ার সামর্থ্য রাখে না, কিংবা সামর্থ্য রাখলেও মিসকীন খুঁজে পায় না; সে ব্যক্তি লাগাতর তিনদিন রোযা রাখবে।
শপথভঙ্গকারী ব্যক্তি যদি তিনদিন রোযা রাখার শ্রেণীভুক্ত হয় সেক্ষেত্রে এ রোযাগুলোর মাধ্যমে শাওয়ালের ছয় রোযার নিয়ত করা জায়েয হবে না। কেননা, এ দুইটি স্বতন্ত্র দুটি ইবাদত। একটি দিয়ে অপরটি আদায় হবে না। বরং সে ব্যক্তি শাওয়ালের ছয় রোযা রাখবে। তারপর ছয়দিনের উপর আর তিনটি রোযা অতিরিক্ত রাখবে।
[ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব, (/৮৪,৮৫)]এই তিনদিনের রোযা লাগাতর হওয়া শর্ত নয়। ইতিপূর্বে 12700 নং ফতোয়াতে আমরা সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছি। সেখানে দেখা যেতে পারে।
আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
সূত্র: islamqa.info