হারাম ও কবিরা গুনাহ

শরীয়ত যদি ধূমপানকে হারাম স্বীকৃতি দিয়ে থাকে তাহলে এর ব্যবসায়ী, প্রস্তুতকারক এবং ক্রেতার ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কি? তাদের এ কাজ কি হারাম না হালাল?

প্রশ্ন :  মিসরীয় মুফতী শাইখ নাসর ফরিদ ওয়াসেলকে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো করা হয়েছে: শরীয়ত যদি ধূমপানকে হারাম স্বীকৃতি দিয়ে থাকে তাহলে এর ব্যবসায়ী, প্রস্তুতকারক এবং ক্রেতার ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কি? তাদের এ কাজ কি হারাম না হালাল? এর লভ্যাংশ হারাম না হালাল? এবং এ লভ্যাংশ সদকা করা, তা দিয়ে হজ্জ করা এবং যাবতীয় ভাল কাজ করা হারাম না হালাল?

উত্তর: আলহামদু লিল্লাহ।

ইসলামী শরীয়তে স্থায়ী মূলনীতি হলো: আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করে সম্মানিত করেছেন, তাদেরকে প্রতিনিধি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তা আবাদ করার জন্য এবং এর গুপ্তধন ও কল্যাণগুলো খোঁজে বের করার জন্য, তাদেরকে গ্রহণ করার জন্য বিশ্বকে উপযোগী করে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন যেন তারা পৃথিবীতে প্রতিনিধি হতে পারে।

আল্লাহ বলেন:

﴿ وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ إِنِّي جَاعِل  فِي ٱلۡأَرۡضِ خَلِيفَة ۖ …﴾ [البقرة: ٣٠]

“আর আপনার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদিগকে বললেন: আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে চাচ্ছি …” [বাক্বারা: ৩০]। মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা প্রতিনিধি করার অর্থই হচ্ছে তাদেরকে অন্যান্য সকল সৃষ্টির উপর সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া।

তিনি বলেন:

﴿۞وَلَقَدۡ كَرَّمۡنَا بَنِيٓ ءَادَمَ وَحَمَلۡنَٰهُمۡ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ وَرَزَقۡنَٰهُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَفَضَّلۡنَٰهُمۡ عَلَىٰ كَثِير  مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِيل ا ٧٠ ﴾ [الاسراء: ٧٠]

“নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে জলে ও স্থলে চলাচলের জন্য বাহন দান করেছি, তাদেরকে পবিত্র ও ভাল জীবিকা দিয়েছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” [সূরা বানী-ইসরাঈল: ৭০]

আর মানুষকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা এসেছে অন্যান্য সকল সৃষ্টির উপর সুস্থ জ্ঞান দ্বারা পার্থক্যের মাধ্যমে। পৃথিবীতে মানুষের আগমনের এটিই অর্পিত দায়িত্ব যাকে মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ধরা হয়।

তিনি বলেন:

﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ مَآ أُرِيدُ مِنۡهُم مِّن رِّزۡق  وَمَآ أُرِيدُ أَن يُطۡعِمُونِ ٥٧ إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلرَّزَّاقُ ذُو ٱلۡقُوَّةِ ٱلۡمَتِينُ ٥٨ ﴾ [الذاريات: ٥٦،  ٥٨]

“শুধু আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি, আমি তাদের নিকট জীবিকা চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমার আহার্য যোগাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা জীবিকাদাতা অধিক শক্তিধর পরাক্রান্ত।” [সূরা যারিয়াত: ৫৬-৫৮]

মানুষকে আল্লাহ সম্মান দেওয়ার বহু দিক রয়েছে, এর মধ্যে: আল্লাহ মানুষকে নিজের নাফস, শরীর এবং অন্যান্য মানুষকে হেফাজত করার নির্দেশ দিয়েছেন বিধায় তার নিজেকে এবং অন্যদেরকে যে কোনো ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া উচিত নয়।

আল্লাহ বলেন:

﴿ وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيم ا ﴾ [النساء: ٢٩]

“তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত অনুগ্রহশীল।” [সূরা নিসা: ২৯]

তিনি আরও বলেন:

﴿وَلَا تُلۡقُواْ بِأَيۡدِيكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ وَأَحۡسِنُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ﴾ [البقرة: ١٩٥]  

“তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা, আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালবাসেন।” [সূরা বাকারা: ১৯৫]

তারপরও ইসলামী শরীয়তের মূল উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয় বিষয় হল পাঁচটি জিনিস- দ্বীন, নাফস, বংশ, জ্ঞান এবং সম্পদকে রক্ষা করা। এর কোনো একটি হারালে তা ধ্বংসের শামিল; যা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। কারণ মানুষের মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং সবকিছু তারই সৃষ্টি, কাজেই এ ইন্দ্রিয়গুলোর ব্যাপারে কোনো মানুষের এ রকম হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় যাতে এর ক্ষতি হয় বা বিনাশ এবং ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। মানুষ তার নিজের উপর বা তার কোনো অঙ্গের উপর অথবা অন্য কারো উপর যে কোনো ক্ষতি সাধন করাকে ইসলামী শরীয়ত হারাম করেছে এবং যারা তা করবে তাদেরকে জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকার অঙ্গিকার দিয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

«وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ عُذِّبَ بِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ»

“যে ব্যক্তি কোনো লোহা দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে সর্বদা ঐ লোহা দ্বারা তার পেটে আঘাত করতে থাকবে।”[28]

এমনিভাবে তার নিজেকে, তার জীবনকে এবং তার স্বাস্থ্যকে রক্ষার জন্য এবং তার নিজের ও অন্যদের থেকে সকল কষ্ট এবং ধ্বংসকে দূরে রাখার জন্য যাবতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যা কিছু মানুষের ক্ষতি ও ধ্বংস বয়ে আনে তা শরীয়তের দিক দিয়ে হারাম। আর যে কোনো পদ্ধতিতে মানুষের ক্ষতি সাধনে কেউ অংশ নিলে বা সহযোগিতা করলে সে আল্লাহর হারাম করা কাজে পতিত হবে। কেননা তিনি বলেন:

﴿ مِنۡ أَجۡلِ ذَٰلِكَ كَتَبۡنَا عَلَىٰ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ أَنَّهُۥ مَن قَتَلَ نَفۡسَۢا بِغَيۡرِ نَفۡسٍ أَوۡ فَسَاد  فِي ٱلۡأَرۡضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ ٱلنَّاسَ جَمِيع ا ﴾ [المائ دة: ٣٢]

“এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, যে কেউ প্রাণের বদলে প্রাণ বা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করে।”[সূরা মায়েদা: ৩২]

আর প্রশ্নের ব্যাপারে বলা যায় যে, ধূমপান শরীয়তের মাপকাটিতে সার্বিকভাবেই হারাম, কারণ এতে ধূমপায়ী ও পার্শ্ববর্তী লোকদের ক্ষতি হয়। বরং ইহা হারাম করার হুকুমটা মদের হারামের চেয়ে কঠোর। কেননা, মদ শুধু মদ্যপায়ীকেই ক্ষতি করে, আর ধূমপান করা ধূমপায়ী এবং অন্যকে তাদের অজান্তে ক্ষতি করা হয় যা বৈজ্ঞানিকদের মতে সাব্যস্ত রয়েছে। যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর হাদীস মদ্যপায়ী, তা বিক্রেতা, বহনকারী, প্রস্তুতকারক, যার জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং যার জন্য বহন করা হয় তাদের সকলের উপর লা‘নত করে তবে ধূমপায়ীও এর মধ্যে শামিল; কারণ ধূমপানে বিরাট ক্ষতি হয়। আর যদি ধূমপান শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম হয় তবে এর ব্যবসায়ী, প্রস্তুতকারক, বিক্রেতা এবং ক্রেতার যাবতীয় কাজ কর্মও হারাম। এর দ্বারা তাদের পাওয়া লভ্যাংশ ও উপার্জনের টাকা হারাম, তা সদকা করা বা কল্যাণকর কোনো কাজে দান করা ঠিক হবে না, কেননা আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্রকেই ভালবাসেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

«أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ} [المؤمنون: 51] وَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ} [البقرة: 172] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟»

‘হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত আর কিছু গ্রহণ করেন না, নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদেরকে সে জিনিসের নির্দেশই প্রদান করেছেন যার নির্দেশ তিনি রাসূলদেরকে দিয়েছেন, তিনি রাসূলদের বলেছেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلرُّسُلُ كُلُواْ مِنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَٱعۡمَلُواْ صَٰلِحًاۖ ﴾ [المؤمنون: ٥١]

“হে রাসূলগণ, আপনারা ভাল পবিত্র খাবার আহার করুন এবং সৎকর্ম সম্পাদন করুন।” [সূরা মুমিনুন: ৫১]

তিনি আরও বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡ ﴾ [البقرة: ١٧٢]

“হে মুমিনগণ, তোমাদেরকে আমি যে পবিত্র খাবার দিয়েছি তাই তোমরা আহার কর।” [সূরা বাকারা: ১৭২]

এরপর তিনি বললেন: ‘কোনো ব্যক্তির দীর্ঘ ভ্রমণ, এলোমেলো কেশ নিয়ে আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে প্রার্থনা করে: হে আল্লাহ! হে আল্লাহ! অথচ তার আহার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক পরিচ্ছেদ হারাম, শরীর গঠন হয়েছে হারাম দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: “তাহলে কীভাবে তার দো‘আ কবুল হবে?”[মুসলিম: ১০১৫]

যদি সে এই টাকা দিয়ে ফরয হজ্জ করে তবে তার ফরয হজ্জ আদায় হয়ে যাবে কিন্তু এর কোনো সাওয়াব বা পূণ্য পাবে না, কারণ সে হারাম টাকা দিয়ে হজ্জ করেছে; যার মধ্যে কোনো ভাল এবং সাওয়াব নেই।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

«وَإِذَا خَرَجَ بِالنَّفَقَةِ الْخَبِيثَةِ، فَوَضَعَ رِجْلَهُ فِي الْغَرْزِ، فَنَادَى: لَبَّيْكَ، نَادَاهُ مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ: لَا لَبَّيْكَ وَلَا سَعْدَيْكَ، زَادُكَ حَرَامٌ وَنَفَقَتُكَ حَرَامٌ، وَحَجُّكَ غَيْرُ مَبْرُورٍ»

‘যখন কোনো ব্যক্তি অপবিত্র মাল দ্বারা হজ্জের জন্য বের হয়ে তার পা বাহনে রেখে লাব্বাইক বলে তাকবীর দেয়; তখন আকাশ থেকে আহ্বানকারী বলতে থাকেন: কোনো লাব্বাইক নয় এবং তোমাকে স্বাগতও নয়, তোমার আহার হারাম, তোমার মাল হারাম এবং তোমার হজ্জ তোমার উপর প্রত্যাখ্যাত[তাবারানী, মু‘জামুল আওসাত্ব: ৫২২৮]।”[ফাতওয়া নং ৮৭২ প্রথম প্রশ্ন, ১৯৯৯ ইং। তবে এর সনদ খুবই দুর্বল। ]

সংকলন: আমের সালেহ আলাওয়ী নাজী
সূত্র: ইসলামহাউজ।

➥ লিংকটি কপি অথবা প্রিন্ট করে শেয়ার করুন:
পুরোটা দেখুন

Mahmud Ibn Shahid Ullah

"যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি একজন মুসলিম, তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার?" আমি একজন তালিবুল ইলম। আমি নিজেকে ভুলের উর্ধ্বে মনে করি না এবং আমিই হক্ব বাকি সবাই বাতিল এমনও ভাবিনা। অতএব, আমার দ্বারা ভুলত্রুটি হলে নাসীহা প্রদানের জন্যে অনুরোধ রইল। ❛❛যখন দেখবেন বাত্বিল আপনার উপর সন্তুষ্ট, তখন বুঝে নিবেন আপনি ক্রমের হক্ব থেকে বক্রপথে ধবিত হচ্ছেন।❞
Back to top button