পবিত্রতা

গোসল ভঙ্গের কারণগুলো কি কি?

প্রশ্ন: আমার নখ যদি লম্বা থাকে ও অপ রিচ্ছন্ন থাকে তাহলে কি আমার গোসল বাতিল হয়ে যাবে? গোসলকালীন সময়ে যা কিছু গোসলকে বাতিল করে দেয় আমি ঐ বিষয়গুলো জানতে চাই। উদাহরণতঃ গোসলকালীন সময়ে পানি ফ্লোরে পড়ে ছিটা আসা। এতে করে কি গোসল বাতিল হবে?     

উত্তর: আলহামদু লিল্লাহ।

গোসল সহিহ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত আছে। যদি এ শর্তগুলো পূরণ না হয় তাহলে গোসল বাতিল হয়ে যাবে। শর্তগুলো হচ্ছে:

প্রথম শর্ত: নিয়ত

রাসূলুল্লাহ্‌সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “প্রত্যেক আমল নিয়ত অনুযায়ী (ধর্তব্য) হয়। প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে সেটাই তার প্রাপ্য।”[সহিহ বুখারী (১) ও সহিহ মুসলিম (১৯০৭)]

তাই তার গোসলের শুরুতে এ গোসলের মাধ্যমে জানাবাত (অপবিত্রতা) উত্তোলন করার নিয়ত করতে হবে।

শাইখ ইয্‌যুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম (রহঃ) বলেন:

নিয়তের উদ্দেশ্য হচ্ছে— ইবাদতগুলোকে অভ্যাসসমূহ থেকে পৃথক করা কিংবা ইবাদতগুলো থেকে অভ্যাসগুলোকে পৃথক করার সময় ইবাদতগুলোর স্তরভেদ নির্ধারণ করা। এর কিছু উদাহরণ হল:

১। আল্লাহ্‌র নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে যেমন গোসল করা হয়; সেটা হল নাপাকি থেকে; আবার মানুষের বিভিন্ন উদ্দেশ্য যেমন- ঠাণ্ডা লাভ, পরিচ্ছ্ন্নতা অর্জন, চিকিৎসা কেন্দ্রিক কিংবা ময়লা-আবর্জনা দূর করা ইত্যাদি উদ্দেশ্য থেকেও গোসল করা হয়। এই উদ্দেশ্যগুলোর প্রেক্ষিতে যেহেতু গোসল করা হয়ে থাকে তাই কোনটি আল্লাহ্‌র নৈকট্য হাছিলের জন্য করা হয় আর কোনটি মানুষের নানা উদ্দেশ্য থেকে করা হয় সেটা পৃথক করা আবশ্যকীয়।[কাওয়ায়েদুল আহকাম (১/২০) থেকে সমাপ্ত]

গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:

আমি পবিত্র অব্স্থায় গোসল করেছি বিধায় বড় অপবিত্রতা দূর করার নিয়ত করিনি। গোসল করার শেষে আমার মনে পড়ল যে, গোসল করার আগে আমি জুনুব (অপবিত্র) ছিলাম। তাই আমার উপর কি পুনরায় গোসল করা আবশ্যকীয়; নাকি আমি ঐ গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা লাভ করেছি?

জবাবে তারা বলেন: যদি আপনি পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও ঠাণ্ডা লাভের নিয়তে গোসল করে থাকেন তাহলে আপনার উপর আবশ্যক পুনরায় বড় পবিত্রতা উত্তোলন করার নিয়তে গোসল করা। কেননা আপনি প্রথম গোসলের মাধ্যমে নিয়ত করেননি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমলগুলো নিয়ত দ্বারা হয়ে থাকে”।

[আল-লাজনাদ দায়িমা লিল বুহুছি ওয়াল ইফতা: সালেহ আল-ফাওযান, আব্দুল আযিয আলে শাইখ, আব্দুল্লাহ্‌বিন গাদইয়ান, আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ্‌বিন বায। [ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমা (৪/১৩৩) থেকে সমাপ্ত]

দ্বিতীয় শর্ত: গোসলের পানি পবিত্র হওয়া

ইবনে আব্দুল বার (রহঃ) বলেন: পানি হয়তো নাপাকি দ্বারা পরিবর্তিত হবে কিংবা অন্য কিছু দ্বারা পরিবর্তিত হবে। যদি নাপাকি দ্বারা পরিবর্তিত হয় তাহলে আলেমগণ ইজমা করেছেন যে, সেই পানি অপবিত্র ও অ-পবিত্রকারী।[আত্‌-তামহীদ (১৯/১৬)]

তাই কেউ যদি গোসল শুরু করে, এরপর খেয়াল করে যে, পানি নাপাক তাহলে তার কর্তব্য হল: পবিত্র পানি দিয়ে পুনরায় গোসল করা।

পক্ষান্তরে যে পানির ছিটা এসে পড়ে ও গোসলকারীর শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে পড়ে সেই পানি পবিত্র।

ইবনুল মুনযির (রহঃ) বলেন:

আলেমগণ এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, যে অপবিত্র ব্যক্তির শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নাপাকি নাই সে যদি তার মুখে ও হাতে পানি ঢালে এবং সে পানি তার উপর দিয়ে, তার কাপড়ের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে সে পানি পবিত্র। কারণ সেটা পবিত্র পানি পবিত্র শরীরে লেগেছে…।

আলেমদের ইজমার মধ্যে রয়েছে যে, ওযুকারী ও গোসলকারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লেগে থাকা পানি ও ফোঁটা ফোঁটা করে কাপড়ের উপর পড়া পানি পবিত্র: এটি ব্যবহৃত পানি পবিত্র হওয়ার দলিল।[আল-আওসাত (১/২৮৮) থেকে সমাপ্ত]

যদি কোন মুসলিম পবিত্র পানি দিয়ে গোসল করে এবং সেই পানি পবিত্র ফ্লোরের উপর পড়ে অতঃপর সেই পানির ছিটা পুনরায় শরীরে পড়ে তাহলে সেটা গোসলের শুদ্ধতার উপর বা শরীরের পবিত্রতার উপর কোন প্রভাব ফেলবে না।

বর্তমান যুগের গোসলখানাগুলো: মলত্যাগের স্থান গোসলের স্থান থেকে আলাদা। তাই গোসলের স্থান নাপাক হয় না। গোসলের ফ্লোরের ব্যাপারে নিছক সন্দেহ ধর্তব্য নয়; যাতে করে ওয়াসওয়াসার পথ উন্মুক্ত না হয় এবং ফ্লোরে পড়া পানিকে কিংবা গোসলকালে গায়ে পড়া পানির ছিটাকে নাপাক বলে হুকুম দেয়া যায় না। হ্যাঁ; যে ফ্লোরে গোসল করা হচ্ছে সেই ফ্লোরে নাপাকি আছে মর্মে যদি জানা যায় তাহলে ভিন্ন কথা।

তৃতীয় শর্ত: গোটা দেহে পানি পৌঁছা। যাতে করে শরীরে এমন কিছু না থাকে যা পানি চামড়ায় পৌঁছা বা চুলে পৌঁছাকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ জানাবাত বা অপবিত্রতা গোটা দেহের সাথে সম্পৃক্ত।

ইমাম নববী বলেন: “তারা এই মর্মে ইজমা করেছেন যে, জানাবাত গোটা দেহে আপতিত হয়।”[আল-মাজমু (১/৪৬৭) থেকে সমাপ্ত]

তাই চামড়ার উপরে যদি কোন ডাক্তারি প্লাস্টার থাকে কিংবা চুলের উপর এমন কোন পদার্থ থাকে বা চমড়ার উপর থাকে যা পানি পৌঁছতে বাধা দেয় তাহলে এমতাবস্থায় গোসল শুদ্ধ হবে না। অবশ্যই এ জিনিসগুলো দূর করতে হবে যাতে করে গোসল শুদ্ধ হয়।

লম্বা নখের নীচে ময়লা থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানির তারল্যের কারণে সেটি নখের নীচে পানি পৌঁছতে বাধা সৃষ্টি করে না। যদি বাধা সৃষ্টি করে তাহলে সেটি যৎসামান্য বিধায় ক্ষমার্হ। তাছাড়া যেহেতু এটি মানুষের মাঝে ঘটাটা প্রসিদ্ধ; কিন্তু শরিয়ত ওযু বা গোসলকালে নখের নীচে পানি পৌঁছানো নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়নি।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন:

যদি নখের নীচে ময়লা থাকে: যদি তা কম হওয়ায় নখের নীচে পানি পৌঁছতে বাধা না দেয় তাহলে ওযু শুদ্ধ। আর যদি বাধা দেয়: সেক্ষেত্রে মুতাওয়াল্লি অকাট্যভাবে বলেছেন যে, যথেষ্ট হবে না এবং অপবিত্রতা দূর করবে না। যেমনিভাবে শরীরের অন্য জায়গায় ময়লা থাকলেও অপবিত্রতা দূর হত না।

আল-গাজালি “আল-ইহইয়া” গ্রন্থে নিশ্চিত করেন যে, যথেষ্ট হবে এবং ওযু-গোসল শুদ্ধ হবে এবং প্রয়োজনের কারণে এটি ক্ষমার্হ। তিনি বলেন: যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নখ কাটার নির্দেশ দিতেন, নখের নীচের ময়লাকে অপছন্দ করতেন; কিন্তু পুনরায় নামায পড়ার নির্দেশ দেননি।[আল-মাজমু (১/২৮৭) থেকে সমাপ্ত]

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন:

যদি যৎসামান্য নখের ময়লা পানি পৌঁছতে বাধা দেয় তাহলেও পবিত্রতা অর্জন শুদ্ধ হবে।[আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা (৫/৩০৩) থেকে সমাপ্ত]

এই পয়েন্টে আরও বেশি জানতে 265777 নং ও 27070 নং প্রশ্নোত্তরটি দেখুন।

চতুর্থ শর্ত: এটি আলেমদের মাঝে মতভেদপূর্ণ বিষয়। সেটি হচ্ছে— গোসলের অঙ্গগুলোর মাঝে পরম্পরা রক্ষা করা এবং দীর্ঘ সময়ের বিরতি না ঘটা।

ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন:

“অধিকাংশ আলেম গোসলের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে গোসল বাতিলকারী হিসেবে মনে করেন না। তবে রবিআ বলেন: যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তা করবে আমি মনে করি তার উপর পুনরায় গোসল করা আবশ্যক। লাইছও এ কথা বলেছেন। মালেক থেকে একাধিক অভিমত এসেছে। ইমাম শাফেয়ির ছাত্রদেরও এক অভিমত হচ্ছে এটি।

তবে জমহুর আলেম যে মতের উপর আছেন সেটাই উত্তম। গোসলে তারতীব বা ক্রমবিন্যাসই ওয়াজিব নয় সুতরাং পরম্পরাও ওয়াজিব নয়।[আল-মুগনী (১/২৯১-২৯২) সমাপ্ত]

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) “যাদুল মুসতাকনি” গ্রন্থের ব্যাখ্যায় বলেন:

গ্রন্থাকারের কথার সরাসরি ভাব হল: গোসলে পরম্পরা শর্ত নয়। অতএব কেউ যদি তার শরীরের কিছু অংশ ধৌত করে এরপর দীর্ঘ সময় পর অবশিষ্ট অংশ ধৌত করে তাহলে তার গোসল সহিহ। এটাই মাযহাবের অভিমত।

কেউ কেউ বলেছেন: পরম্পরা রক্ষা করা শর্ত। এটি ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণিত। বর্ণিত আছে: এটি ছাত্রদের অভিমত…।

এটি -অর্থাৎ পরম্পরা শর্ত হওয়াটা- অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ অভিমত। কারণ গোসল গোটাটাই একটি ইবাদত। তাই গোসলের একাংশ অপরাংশের উপর পরম্পরার ভিত্তিতে সংঘটিত হওয়া অনিবার্য।

তবে, কেউ যদি ওযরের কারণে বিক্ষিপ্ত ভাগে গোসল করে; যেমন পানি শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে এরপর যদি পানি পায় তাহলে প্রথমে যে অংশ ধুয়েছে পুনরায় সে অংশ ধোয়া আবশ্যক হবে না। বরঞ্চ অবশিষ্টাংশ পরিপূর্ণ করবে।[আল-শারহুল মুমতি (১/৩৬৫) থেকে সমাপ্ত]

তাই একজন মুসলিমের কর্তব্য নিজের গোসলের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা। গোসলের অংশগুলোর মাঝে লম্বা সময়ের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি না করা; যাতে করে মতভেদের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন এবং নামাযের শুদ্ধতার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ। 

সুত্র: Islamqa.info

➥ লিংকটি কপি অথবা প্রিন্ট করে শেয়ার করুন:
পুরোটা দেখুন
এছাড়াও পড়ে দেখুন
Close
Back to top button