বিবাহ ও দাম্পত্য

স্বামী তার স্ত্রীর ওপর শর্তারোপ করেছিলেন যে, স্বামীর একজন আত্মীয়াকে স্ত্রীর সাথে একই বাসায় থাকতে দিতে হবে। এখন এই আত্মীয়া স্ত্রীকে নানাভাবে কষ্ট দিচ্ছেন। এমতাবস্থায় স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর ওপর আরোপকৃত শর্ত কি বাতিল হবে?

প্রশ্নঃ আমি একজন নারী। বছর খানেক আগে আমার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পূর্বে আমার স্বামী আমার ওপর শর্তারোপ করেছিলেন যে, তাঁর মায়ের খালার মেয়েকে আমাদের বাসায় থাকতে দিতে হবে; যেহেতু তিনি একজন বয়স্ক মহিলা। স্বামীর এ শর্তে আমি রাজী হয়েছিলাম।

বিয়ের পর আমি জানতে পারলাম যে, এ বাড়ীর অর্ধেক আসবাবপত্র এই মহিলার। বাসার কোন একটি আসবাবপত্র আমি ধরতে পারি না, ছুঁইতে পারি না। শুধু তাই নয়- তিনি আমাকে, আমার পরিবারকে গালিগালাজ করেন। আমার স্বামী এর কোন প্রতিবাদ করে না।

ভদ্রমহিলা বলেন: আমার পিতা নাকি জারজ সন্তান! আমার মধ্যে নাকি আদব কায়দা কম! কারণ- আমার স্বামী ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় আমি তার সাথে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যাই। এ বিষয়গুলো আমি আমার পরিবারকে অবহিত করলে তারা এসে আমাকে নিয়ে যায়।

বর্ণিত অবস্থার প্রেক্ষিতে আমি কি আমার স্বামীর নিকট আলাদা বাসস্থান দাবী করতে পারি? এই ভদ্রমহিলা আমাদের সাথে বসবাস করার শরয়ি বিধান কি?

উত্তরঃ আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য)।

এক:নিজের স্ত্রীকে ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত বৈশিষ্ট্য সম্বলিত একটি বাসস্থান প্রদান করা স্বামীর অপরিহার্য কর্তব্য।যে বাসস্থানের মধ্যে স্ত্রীর জীবন ধারণের জন্য অতিজরুরী সুবিধা গুলো থাকবে।এই আবাসস্থলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে- স্ত্রীর সাথে একই ঘরে স্বামীর পরিবারের কোন সদস্যকে না রাখা।

দুই:কিন্তু স্বামী যদি স্ত্রীর ওপর শর্তারোপ করে থাকে যে, স্ত্রীর সাথে স্বামীর পরিবারের কোন সদস্যকে থাকতে দিতে হবে এবং স্ত্রী যদি এই শর্তে রাজী হয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রী তার স্বামীর পক্ষ থেকে আলাদা বাসা পাওয়ার অধিকার হতে বঞ্চিত হবে।আরোপ কৃত শর্তটি মেনে যাওয়া স্ত্রীর ওপর শিরোধার্য হয়ে যাবে, স্ত্রীকে শর্তটি পূর্ণ করতে হবে।

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: শর্ত বিষয়ক অধ্যায়ের মূলনীতি হলো- যেকোন শর্ত আরোপ করা জায়েয এবং শুদ্ধ। সেটা বিয়ের ক্ষেত্রে হোক, বেচাকেনার ক্ষেত্রে হোক, ভাড়ার ক্ষেত্রে হোক, বন্ধকের ক্ষেত্রে হোক, অথবা ওয়াকফের ক্ষেত্রে হোক।

যেকোন প্রকার চুক্তির শর্তের বিধান হলো- শর্ত শুদ্ধ হলে সেটি পূর্ণ করা ওয়াজিব (অপরিহার্য)।সেটি বিয়ের চুক্তি হোক অথবা অন্য কোন চুক্তি হোক।যেহেতু চুক্তি সংক্রান্ত আল্লাহর বাণীটির বিধান সাধারণ- “হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের চুক্তির প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কর।”[সূরা মায়েদা, আয়াত- ১]।

আর চুক্তি পূর্ণ করা মানে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত শর্ত ও বৈশিষ্ট্যসহ তা পূর্ণ করা।যেহেতু চুক্তির শর্ত ও চুক্তি হিসেবে গণ্য। [আল-শারহুল মুমতি’ আলাযাদিল মুসতানকি’, পৃষ্ঠা- ১২/১৬৪]

পূর্বোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়- আপনার জন্য স্বামীর আরোপকৃত শর্ত পূরণ করা এবং আপনার স্বামীর মায়ের খালার মেয়েকে আপনার সাথে থাকতে দিয়ে সন্তুষ্ট থাকা অনিবার্য।যেহেতু আপনি বিয়ের পূর্বেই এ শর্ত সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছেন।

তিন:নিম্নোক্ত কিছু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আরোপকৃত এ শর্তটি বাতিল হতে পারে:

১.যদি শর্ত আরোপকারী অর্থাৎ আপনার স্বামী শর্তটি বাতিল করে দেন।তিনি যদি শর্তটি বাতিল করেন তাহলে যেন তিনি শর্তটি আরোপই করেন নি।

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: ইসলামী শরিয়ত যে শর্তগুলো আরোপ করেছে সে শর্তগুলো রহিত করার অধিকার কেউই রাখেন না।আর কোন ব্যক্তি নিজে যে শর্তগুলো আরোপ করেন তিনি সে শর্তগুলো রহিত করার অধিকার রাখেন।[আল-শারহুল মুমতি’ আলাযাদিল মুসতানকি’, পৃষ্ঠা- ৫/২৫]

২.আপনি যাকে আপনার সাথে একত্রে বসবাস করতে দিতে সম্মত হয়েছেন আপনি তার দ্বারা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সাব্যস্ত হয়।যেমন- অপ্রাপ্তবয়স্ক আত্মীয় প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেল অথবা দুশ্চরিত্রবান কোন ব্যক্তি যে আপনার গোপন বিষয় খুঁজে বেড়ায় অথবা এমন কোন ব্যক্তি যে গালিগালাজ করে, হেয় প্রতিপন্ন করে, শারীরিক ভাবে অথবা মানসিক ভাবে আপনাকে কষ্ট দেয়।

যেহেতু আপনার স্বামী তার শর্তটি রহিত করেনি সুতরাং আপনার সামনে শুধু দ্বিতীয় পথটিই খোলা আছে।তবে আপনার অভিযোগটি সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে সাব্যস্ত করতে হবে।যদি সাব্যস্ত করা যায় তাহলে আপনি এই মহিলাকে আপনাদের ঘর থেকে বের করে দিতে পারবেন অথবা আপনি অন্য কোন ঘরে আলাদাভাবে থাকতে পারবেন।

কুয়েত থেকে প্রকাশিত “আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়া (ফিকহী বিশ্বকোষ)” তে এসেছে- স্ত্রীর সাথে একই ঘরে পিতামাতা (বা অন্য কোন আত্মীয়) কে বসবাস করতে দেয়া জায়েয নয়।

তাই স্বামীর কোন আত্মীয়ের সাথে একত্রে বসবাস করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করার অধিকার স্ত্রীর রয়েছে।আলাদা বাসাতে থাকলে স্ত্রী তার ইজ্জত, সম্পদ ও অন্যান্য অধিকার উপভোগ করার পূর্ণ নিশ্চয়তা পেতে পারে।সুতরাং এ অধিকার পরিত্যাগে তাকে বাধ্য করার সাধ্য কারো নেই।এটি হানাফি, শাফেয়ি, হাম্বলি মাযহাবসহ জমহুর ফিকাহবিদ গণের অভিমত।

আর স্বামী যদি স্ত্রীর ওপর এ শর্তারোপ করে থাকে যে, স্ত্রীকে স্বামীর পিতা মাতার সাথে বসবাস করতে হবে এবং স্ত্রী এ শর্ত গ্রহণ করে তাদের সাথে বসবাস করা শুরু করে; কিন্তু পরবর্তীতে আলাদা বাসা দাবী করে তাহলে মালেকি মাযহাব মতে স্ত্রী আলাদা বাসা পাবে না।তবে এক অবস্থায় স্ত্রী আলাদা বাসা পেতে পারেন যদি তিনি সাব্যস্ত করতে পারেন যে, তাদের সাথে একত্রে বসবাস করে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এতক্ষণ যা আলোচিত হয়েছে তা মূল মাসয়ালার বর্ণনা ও আপনার মত পরিস্থিতির-শিকার ব্যক্তির ক্ষেত্রে কি করণীয় তার উল্লেখমাত্র।কিন্তু আপনারদের মাঝে যে সমস্যা সেটা শুধু তাত্ত্বিক বক্তব্য দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়।বরঞ্চ এ সমস্যার নিরসন কল্পে দুই পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন।

আপনার স্বামী যদি আপনার ও তার আত্মীয়ার মাঝে সৃষ্ট সংকট নিরসনে অপারগ হন এবং স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন যাপনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে না-পারেন সেক্ষেত্রে আপনার জন্য ও তার আত্মীয়ার জন্য আলাদা আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করা তার ওপর ওয়াজিব

তিনি যদি তা না-করেন তাহলে আপনাদের মাঝে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনের জন্য কোন মধ্যস্থতাকারীর শরণাপন্ন হন।যে মধ্যস্থতাকারী আপনার স্বামীকে নিজের ঘর সংরক্ষণের ব্যাপারে তার চেতনা ফিরাতে পারবে এবং একথা বুঝাতে পারবে যে, আপনার স্বামী আপনার জন্য অথবা তার আত্মীয়ার জন্য কাছাকাছি স্থানে আলাদা একটি বাসা ভাড়া নিতে পারেন।যাতে আপনার স্বামী তার বৃদ্ধ আত্মীয়ার দেখাশুনা করতে পারেন এবং তার ঘর ও পরিবারের হক ও আদায় করতে পারেন।

যদি আপনার স্বামী এতে সম্মতি না হন, তাহলে আপনি আদালতের বিচারপ্রার্থী হতে পারেন।এটাই সমস্যা নিরসনের শেষ সমাধান।

আমরা দোয়া করছি আল্লাহ আপনাদের উভয় পক্ষের মাঝে সমঝোতা করে দিন এবং আপনাদের উভয় পক্ষকে সুমতি দিন।আল্লাহই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

➥ লিংকটি কপি অথবা প্রিন্ট করে শেয়ার করুন:
পুরোটা দেখুন

আবু রায়হান

আসসালামুআলাইকুম, আমি একজন প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্র। আমি এটা মনে করিনা যে, আমার টাই সঠিক আর বাকি সবারটা ভুল। আমি এই পথে হাটছি, আমি আপনার কাছে দো'আ প্রার্থী, আল্লাহ তাআলা যেন আমাকে অনেক দূর অগ্রসর হওয়ার ও বড় আলেম হয়ে ইসলামের খেদমত করার তাওফিক দান করেন এবং সঠিকটা বুঝে সেই অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করেন। আর আমার ভুল ভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দিবেন।
এছাড়াও পড়ে দেখুন
Close
Back to top button