প্রশ্ন : বাউলদের উৎপত্তি কোথা থেকে? বাউল-ফকীরদের আক্বীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে চাই।
এই লোকধর্মের সাধকদের তত্ত্ব ও দর্শন সম্বলিত গানকে ‘বাউল গান’ বলে। বাউলরা
সঙ্গীতাশ্রয়ী, মৈথুন ও দেহভিত্তিক গুপ্ত সাধনার অনুসারী। এই সাধনায় সহজিয়া
ও ছূফী ভাবধারার সম্মিলন ঘটেছে। তারা না মুসলিম, না হিন্দু। তারা নিজেদেরকে মানবধর্মের অনুসারী বলে দাবী করে। তারা মসজিদ বা মন্দিরে যায় না।
কোন ধর্মগ্রন্থে তাদের বিশ্বাস নেই। তারা কোন ধর্মীয় আচারও পালন করে না। তাদের জানাযাও হয় না বা তাদের লাশ পোড়ানোও হয় না। তারা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও স্বীকার করে না। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও বসবাসকে দর্শন
হিসাবে অনুসরণ করে।
এদের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে, প্রাচীন
ফিলিস্তীনে রাস-সামারায় বা‘আল নামের এক প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হ’ত।
বা‘আল প্রজনন দেবতা হওয়ায় মৈথুন এই ধর্মের অংশ হয়ে পড়ে। অষ্টম-নবম দশকে
পারস্যে ছূফী সাধনার উদ্ভবকালে বা‘আল নামক এক ছূফী ধারা গড়ে ওঠে। তারা
মরুভূমিতে গান গেয়ে বেড়াত। অন্যান্য ছূফী সাধকদের মত তারা পারস্য থেকে ভারত
উপমহাদেশে আগমন করে এবং ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই বাংলায়
বাউল সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে। কারো মতে, সংস্কৃত শব্দ বাতুল (পাগল) কিংবা
ফার্সী শব্দ বা‘আল (পাগল, বন্ধু) থেকে বাউল শব্দের উদ্ভব। প্রেমাস্পদের
উদ্দেশ্যে সংসারত্যাগী ও উন্মাদ হয়ে গান গেয়ে বেড়ানোর কারণে তাদেরকে বাউল
বলা হয়। গান-বাজনা হ’ল তাদের ধর্মপ্রচারের একমাত্র মাধ্যম। বিভিন্ন খানকা,
মাযার, আখড়া তাদের ধর্ম প্রচারকেন্দ্র (বাংলাপিডিয়া, ড. আনোয়ারুল করীম, ‘বাংলাদেশের বাউল’ ১৫-১৭ পৃ.)।
ড. আহমাদ শরীফের মতে, ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমন্বয়ে যে মিশ্র
সম্প্রদায় গড়ে ওঠে তারা এক সময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু
পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলে তারা পুরনো প্রথাতেই ধর্ম
সাধনা করে চলছে। ফলে বাউল মত না ইসলাম, না হিন্দু ধর্মের অনুসরণ করে। বরং
তারা নিজের মনের মত করে পথ তৈরী করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে, কালী, কৃষ্ণ,
গড, খোদা/ কোন নামে নাহি বাধা/মন কৃষ্ণ গড খোদা বল রে (বাউল তত্ত্ব, পৃ. ৫৩-৫৪)।
বাউলদের বিশ্বাস হ’ল, তারা সর্বেশ্বরবাদী। দেহ ও কামাচার এদের কাছে ঐশ্বরিক। দেহের
বাইরে কিছু নেই। এখানেই আল্লাহ, নবী, কৃষ্ণ, ব্রহ্মা, পরমাত্মা একাকার।
অর্থাৎ ঈশ্বর ও বিশ্বজগৎ অভিন্ন দুই সত্তা। যখন কেউ সাধনার শীর্ষে আরোহণ
করে তখন সে ঈশ্বর (আনাল হক) হয়ে যায়। প্রচলিত ছূফীবাদের মত বাউল ধর্মেও
দেহের মধ্যে পরমাত্মার উপস্থিতি স্বীকার করা হয়। এর চূড়ান্ত অবস্থায় নিজেকে
ঈশ্বরের পর্যায়ভুক্ত মনে করা হয়। একে অপরের মধ্যে ফানা (বিলীন) হয়ে যায় (উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বাংলার বাউল, পৃ. ৪৮২)।
তাদের আল্লাহ ও রাসূলের নাম নেওয়া এবং আরবী ও ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করা
দেখে অনেকে তাদেরকে মুসলিম মনে করে। অথচ তাদের জীবনাচরণ মূলত হিন্দু ও
বৌদ্ধ ধর্মীয় দর্শন ও উপাসনা রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত।
বাউলরা গুরুবাদী। গুরু বা সাঁইকে এরা ঈশ্বরের অবতার মনে করে। এরা বিশ্বাস করে যে,
গুরু অসন্তুষ্ট হ’লে তার ইহকাল, পরকাল সবই বিনষ্ট হ’তে পারে। গুরুকে তুষ্ট
করাই এদের সাধনার অঙ্গ। বাউল সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হ’ল
ফকীর লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০খ্রি.)।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে জন্মগ্রহণকারী এই
বাউল সাধকের মাধ্যমেই বাংলায় বাউল গানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। তার ধর্মপরিচয়
জানা যায় না। কেননা তিনি কোন ধর্মীয় রীতি-নীতি মানতেন না। তিনি বিশ্বাস
করতেন, সকল মানুষের মধ্যে বাস করে একজন ‘মনের মানুষ’, যার কোন ধর্ম,
জাত-পাত, বর্ণ, লিঙ্গ নেই। সেই অজানা, অস্পৃশ্য ও রহস্যময় মনের মানুষই ছিল
তার ধ্যান-জ্ঞান, যাকে তিনি ঈশ্বর মনে করতেন। তার মতে, পার্থিব দেহ সাধনার
ভেতর দিয়ে দেহোত্তর জগতে পৌঁছানোর মাধ্যমে সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া
যাবে। আর তাতেই হবে মোক্ষ বা মহামুক্তি লাভ। যেহেতু কোন ধর্ম অনুসরণ করতেন
না, তাই তার মৃত্যুর পর তার লাশ ধর্মীয় রীতিতে সৎকার করা হয়নি। তবে তার
শিষ্যরা তাকে নবী বা সাঁইজি মনে করে। তার মাযারকে তাদের তীর্থভূমি মনে করে।
তাদের কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ লালন রাসূলুল্লাহ (সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, পৃ. ৯৪-৯৫)।
বাউলদের মতে, জন্ম-জীবন সবসময় উপভোগ্যময়। গানকে ধারণ করে মনকে তারা আনন্দময় করে
তুলতে চায়। বাউল সাধনায় অবাধ যৌনাচার ও গাঁজা সেবন আবশ্যক। একজন বাউলের
একাধিক সেবাদাসী থাকে। সঙ্গিনী ছাড়া তাদের সাধনা অচল। তারা মনে করে, মদ
খাওয়া অনৈতিক, কেননা তা উশৃঙ্খল করে তোলে। কিন্তু তামাক ও গাঁজার নেশা
মানুষকে আত্মমগ্ন করে মনকে উর্ধ্বগামী করে দেয়। তারা সাদামাটা, বৈরাগী জীবনযাপনের নামে নোংরা ও জটাধারী থাকতে পসন্দ করে। রোগমুক্তির জন্য তারা স্বীয় মূত্রও পান করে। এছাড়া সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মূত্র,
রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরী করে তা ভক্ষণ করে
(বাংলাদেশের বাউল পৃ. ৩৫০, ৩৮২)।
সুতরাং বাউল একটি সর্বেশ্বরবাদী, পথভ্রষ্ট ও বৈরাগী জীবনধারায় অভ্যস্ত সম্প্রদায়। এদের
সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে এবং এদের মুসলিম নামের কারণে সাধারণ মুসলমানরা
তাদের কেবল মুসলমানই মনে করে না, বরং তাদেরকে ছূফী-সাধকের মর্যাদায় বসায়।
অথচ এরা আক্বীদা ও আমলগতভাবে মুসলিম নয়; বরং এক মিশ্র ধর্মের অনুসারী।
সুতরাং এদের আক্বীদা, উপসনাপদ্ধতি ও গান-গযল থেকে সর্বোতভাবে বেঁচে থাকা আবশ্যক।
সূত্র: মাসিক আত-তাহরীক।